• মঙ্গলবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৪৫ অপরাহ্ন
  • |
  • |

পাচারকারীসহ আরও কিছু কারণে হুমকির মুখে সুন্দরবনের বাঘ

স্পষ্টবাদী ডেস্ক / ১৩ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই, ২০২৫
পাচারকারীসহ আরও কিছু কারণে হুমকির মুখে সুন্দরবনের বাঘ

সুন্দরবনে পাচারকারীদের হাতে বেশি মারা পড়ছে বাঘ। হরিণ শিকার বন্ধ না হওয়ায় বাঘের খাদ্যসংকট তৈরি হচ্ছে, যা পরোক্ষভাবে তাদের জন্য বড় হুমকি। পাশাপাশি শিল্পদূষণ, লবণাক্ততা ও অপরিকল্পিত পর্যটনের চাপে বাঘ ক্রমে বিপন্ন হচ্ছে। সুন্দরবন ও বাঘ সুরক্ষা নিয়ে কাজ করেন এমন পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

২০১৮ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিং–পদ্ধতিতে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪। ২০২৪ সালে নতুন জরিপে এই সংখ্যা বেড়ে ১২৫টিতে দাঁড়িয়েছে। সংখ্যায় কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও বাঘের জীবনের হুমকি আগের চেয়ে কমেনি, বরং বেড়েছে বহুগুণ।

বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত আড়াই দশকে সব মিলিয়ে মারা যাওয়া বাঘের সংখ্যা ৬২। এর মধ্যে পাচারকারীদের হাতে মারা পড়েছে ২৬টি। স্বাভাবিক মৃত্যু ২১, গ্রামবাসীর হাতে মৃত্যু ১৪ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১টি বাঘ মারা পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব বাঘ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি, সুন্দরবনের সমৃদ্ধি’।

এ সম্পর্কে সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘বাঘ হত্যার ঘটনা বর্তমানে কিছুটা কমলেও হুমকি বহুগুণ বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে পড়ায় বাঘ বাধ্য হচ্ছে সেই লোনাপানি পান করতে, যা তাদের অসুস্থ করে তুলছে। ঘূর্ণিঝড়, অস্বাভাবিক জোয়ার কিংবা নিম্নচাপের সময় বাঘের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব তাদের টিকে থাকার লড়াইকে আরও কঠিন করে তুলছে।’

বাঘ বিপন্ন হওয়ার বেশ কিছু কারণ জানালেন সুন্দরবন সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, হরিণ শিকার বন্ধ না হওয়ায় বাঘের খাদ্যসংকট তৈরি হচ্ছে, যা পরোক্ষভাবে তাদের জন্য বড় হুমকি। পাশাপাশি বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গোপন বেচাকেনা, শিল্পদূষণ, লবণাক্ততা ও অপরিকল্পিত পর্যটনের চাপে বাঘ ক্রমেই বিপন্ন হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কথায় সচেতন; কিন্তু কার্যক্রমে দুর্বল। বাঘ না থাকলে সুন্দরবন থাকবে না, আর সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশ ভয়াবহ পরিবেশ–সংকটে পড়বে।’

মানবসৃষ্ট পরিবেশদূষণও বাঘের অস্তিত্ব হুমকিতে ফেলছে। এ সম্পর্কে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘বনের চারপাশে অসংখ্য শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে, যেগুলোর বর্জ্য পশুর নদ হয়ে জোয়ারে বনভূমিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে বাঘসহ অন্যান্য প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জাহাজের আলো, শব্দ ও কিছু জেলের বিষ দিয়ে মাছ ধরা—এসব কিছুর সম্মিলিত প্রভাব বাঘের জীবনে ভয়ংকর ছন্দপতন ঘটাচ্ছে।’

আরও গভীর আশঙ্কার কথা বলেন উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব সাইফুল ইসলাম। তাঁর ভাষায়, ‘বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার করে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করতে একটি চক্র সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। ইন্টারপোলের দেওয়া ১৫৩ জনের তালিকা থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গণনার নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় না করে এই চক্রকে নির্মূল করলেই হয়তো বাঘকে রক্ষা করা সম্ভব।’

এ সম্পর্কে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, ‘বাঘ হত্যা বন্ধে আমরা তথ্যদাতাদের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছি। বনের ভেতরে অপরাধী শনাক্ত করতে পারলে ৫০ হাজার, লোকালয়ে হলে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। তবে শুধু আইন দিয়ে কাজ হবে না, প্রয়োজন মানুষের সদিচ্ছা ও সচেতনতা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বাঘ হচ্ছে সুন্দরবনের কিস্টোন প্রজাতি। এই প্রাণী টিকে থাকলে টিকে থাকবে বন। আর বন টিকলে টিকে থাকবে এই দেশের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, এমনকি মানুষও। তাঁর মতে, হরিণ শিকার বন্ধ না হলে বাঘ দুর্বল হয়ে পড়বে, খুঁজবে সহজ শিকার, আর তখনই বাড়বে মানুষ-বাঘ সংঘাত। তাই শুধু বন বিভাগ নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category