১৬ জুলাই, ২০২৪ — বাংলাদেশের ইতিহাসে এক করুণ অথচ গৌরবময় দিন। ঠিক আজকের এই দিনেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নতুন গতি পায়, আর সেই পথচলার প্রথম রক্তাক্ত অধ্যায় রচিত হয় রংপুরের রাজপথে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান তরুণ আবু সাইদ — ইতিহাসে যার নাম লেখা হয় প্রথম শহীদ হিসেবে।
সকালটা ছিল প্রতিদিনের মতোই। কেউ ভাবেনি যে এই সাধারণ সকালটা পরিণত হবে এক অমোচনীয় স্মৃতিতে। রংপুরে বৈষম্যের বিরুদ্ধে তরুণদের শান্তিপূর্ণ মিছিল চলছিল। মিছিলের মাঝে ছিলেন আবু সাইদ। হয়তো মনে মনে ভেবেছিলেন, এই লড়াইয়ে তাঁর ভূমিকা হবে সামান্য— কিছুক্ষণ পরেই হয়তো বাড়ি ফিরবেন, বন্ধুদের সাথে দেখা করবেন, মায়ের মুখে হাসি দেখবেন।
কিন্তু ইতিহাস হয়তো তাঁকে অন্য কিছু লেখার দায়িত্ব দিয়েছিল।
ঠিক তখনই পুলিশ ছোড়ে গুলি— নির্বিচারে, নির্মমভাবে। প্রথম গুলিটি এসে থামে আবু সাইদের বুকে। তরুণ বুকের মধ্যে গুলির শব্দে থেমে যায় জীবন, আর রক্তে ভিজে যায় রাজপথ। তাঁর প্রাণের বিনিময়ে ইতিহাস রচনা শুরু হয়— শহীদের খাতায় প্রথম নাম লেখা হয়ে যায়: আবু সাইদ।
কিছুক্ষণের ব্যবধানে, দেশের আরেকপ্রান্ত চট্টগ্রামেও বুলেট থামে দুই তরুণের শরীরে— একজন ছাত্রদলের ওয়াসিম এবং আরেক শহীদ ফয়সাল। তাঁরা কেউ কাউকে চিনতেন না, কখনও দেখা হয়নি তাঁদের, কিন্তু রাজপথের সেই একই চেতনাবোধে তাঁদের বুক ছিল সমান উঁচু। প্রতিবাদী কণ্ঠ রুদ্ধ করতে যে গুলি ছোঁড়া হয়েছিল, তা এসে একত্র করে দেয় তাঁদের।
শেষবারের মতো হয়তো ওয়াসিম মা’র কাঁধে মাথা রেখে ছিলেন, হয়তো ফয়সাল তাঁর বন্ধুর সাথে শেষ হাসিটুকু ভাগ করছিলেন। কিন্তু তারপরই তাঁরা পা বাড়ান এক অমর পথে— যেখানে মৃত্যু মানেই বিজয়, শহীদ মানেই ইতিহাসের সেরা গৌরব।
আবু সাইদ জানতেন না, তাঁর বুকের রক্ত দিয়ে শুরু হবে ইতিহাস বদলের যাত্রা। ওয়াসিম জানতেন না, তাঁর শেষ নিঃশ্বাস হবে মুক্তির ডাক। ফয়সাল জানতেন না, হাসপাতালের সাদা বিছানায় তাঁদের নিথর শরীর একদিন প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠবে।
১৬ জুলাই এখন আর শুধু একটি তারিখ নয় — এটি একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত, একটি জাতির ঘুম ভাঙার দিন। এই দিনেই রাষ্ট্র জানে যায়, তরুণদের বুকে চেতনাকে গুলি করে থামানো যায় না।
আজ, এক বছর পর, আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই তিন তরুণ শহীদকে— আবু সাইদ, ওয়াসিম ও ফয়সাল।
তাঁদের আত্মদান শুধু রক্তক্ষরণ নয়, এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক নির্ভীক উচ্চারণ।
তাঁদের মৃত্যু নয়, বরং ছিল একটি নতুন ইতিহাসের জন্ম।
১৬ জুলাই — হোক আমাদের লড়াইয়ের শপথ, এবং তাঁদের আত্মত্যাগ হোক আমাদের জাতিসত্তার অহংকার।
লেখক পরিচিতি:
আল মুস্তাসিম নবী নিকু
অ্যাডভোকেট, ঢাকা ও পাবনা জজ কোর্ট