• শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:১০ পূর্বাহ্ন
  • |
  • |

“উপজেলায় আদালত স্থানান্তরের প্রস্তাব: বিকেন্দ্রীকরণ না বিভ্রান্তিমূলক সংস্কার?

আল মোস্তাসিম নবি নিকু / ১৩৪ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই, ২০২৫
আল মুস্তাসিম নবী নিকু

বিচার ব্যবস্থা একটি দেশের আইন ও শাসনের সর্বোচ্চ প্রতীক এবং এর প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা ও প্রত্যাশা দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ন্যায়পরায়ণতার পরিচায়ক। নাগরিকরা বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের অধিকার রক্ষার আশা করে এবং ন্যায়সঙ্গত, স্বচ্ছ ও দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ার প্রত্যাশায় থাকে। তাই বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা দেশের গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অপরিহার্য।
বর্তমান সরকার দেশের বিচার ব্যবস্থাকে আরও উন্নত ও জনবান্ধব করার লক্ষ্যে একটি ব্যাপক বিচার বিভাগীয় সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির গতি বৃদ্ধি, বিচারিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং দুর্নীতি দূরীকরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তরের প্রস্তাব একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।
তবে উপজেলা আদালত স্থানান্তরের বিষয়টি একটি নতুন বিতর্কের সূচনা করেছে। এটি কি সত্যিই বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ এবং সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করবে, নাকি এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, কার্যকারিতা ও স্বচ্ছতার জন্য নতুন ঝুঁকি সৃষ্টি করবে? এই প্রশ্নগুলো বর্তমান আলোচনা ও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে।
এই প্রেক্ষাপটে, প্রস্তাবিত উপজেলা আদালত স্থানান্তরের যৌক্তিকতা ও সম্ভাব্য বিপদসমূহ বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে দেশের বিচার ব্যবস্থা শক্তিশালী ও মানুষের আস্থার পাত্র হিসেবে উন্নত হতে পারে।

উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তরের প্রস্তাব: কী বলা হচ্ছে?
বর্তমান বিচার বিভাগীয় সংস্কার কর্মসূচির অধীনে উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তরের বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হিসেবে উত্থাপিত হয়েছে। বিচার সংস্কার কমিশন এই প্রস্তাবের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থাকে আরও জনগণবান্ধব ও সহজলভ্য করার লক্ষ্যে কাজ করছে।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, উপজেলা সদরের ভৌগোলিক অবস্থা, জেলা সদর থেকে দূরত্ব, যাতায়াত সুবিধা, জনসংখ্যার ঘনত্ব ও মামলার চাপ বিবেচনায় নিয়ে স্থায়ী আদালত স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করতে হবে। বিশেষ করে বর্তমানে যেসব উপজেলায় চৌকি আদালত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলোকে পুনর্বিবেচনা করে স্থায়ী আদালতে রূপান্তরের সম্ভাবনা ও প্রয়োজনীয়তা যাচাই করতে বলা হয়েছে।
এছাড়া, বাস্তব পরিস্থিতির ভিত্তিতে কোনো উপজেলা আদালতের অধিক্ষেত্র একাধিক উপজেলা নিয়ে সমন্বিত করতে হলে তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
প্রস্তাবে উপজেলা আদালতে সিনিয়র সহকারী জজ ও প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট পদায়নের বিষয়েও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে দেওয়ানি মামলায় সিনিয়র সহকারী জজদের আর্থিক এখতিয়ার বাস্তবানুগভাবে বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, যাতে তারা স্থানীয় স্তরে আরও বিস্তৃত ও কার্যকর বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।
অতীতে আইনগত সহায়তার সীমিত কার্যক্রমকে উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারিত করার মাধ্যমে সাধারণ জনগণের ন্যায়বিচারে সহজ ও দ্রুত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরা হয়েছে।
বিচার সংস্কার কমিশন জেলা পর্যায়ের থেকে উপজেলা পর্যায়ে আদালতের কার্যক্রম স্থানান্তর করার সুপারিশ করেছে, যাতে বিচারপ্রক্রিয়া আরও নিকটস্থ ও গ্রহণযোগ্য হয়। এটি বিশেষ করে দূর্গম ও গ্রামীণ এলাকার মানুষের ন্যায়বিচারে সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রস্তাবিত। এছাড়া, মামলার চাপ কমিয়ে বিচার প্রক্রিয়ার গতি বৃদ্ধির প্রত্যাশাও রয়েছে।
উদ্দেশ্য হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে: ন্যায়বিচারে সহজ প্রবেশাধিকার
প্রস্তাবিত আদালত স্থানান্তরের মূল উদ্দেশ্য হলো সাধারণ মানুষের বিচার ব্যবস্থায় সহজ, দ্রুত ও কম ব্যয়বহুল প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। বিশেষ করে যারা অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক বা সামাজিক কারণে জেলা আদালতে যেতে অক্ষম, তাদের জন্য স্থানীয় আদালত থেকে দ্রুত ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব হবে।

আইনগত ও সাংবিধানিক প্রশ্নবোধকতা
উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তরের প্রস্তাবটি শুধু প্রশাসনিক নয়, এটি এক গভীর আইনগত ও সাংবিধানিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিচার বিভাগের কাঠামো ও কার্যপরিধিকে প্রভাবিতকারী যেকোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সংবিধানের মৌলিক বিধান ও আদালতের স্বাতন্ত্র্য প্রশ্নে বিশেষ গুরুত্বারোপ প্রয়োজন।
সংবিধানের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদ: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
বাংলাদেশ সংবিধানের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবে যে, বিচার বিভাগের কার্যাবলি নির্বাহী বিভাগ হইতে পৃথক হইবে।” এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বা আইনসভা থেকে স্বাধীন থাকা উচিত। বিচারকদের বিচারিক কাজ পরিচালনায় স্বাধীনতা রক্ষা করা সংবিধানের একটি মৌলিক ভিত্তি। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থাপনের ফলে যদি স্থানীয় নির্বাহী কর্তৃপক্ষের (যেমন—উপজেলা নির্বাহী অফিসার) সঙ্গে বিচারিক কাজের সংযোগ তৈরি হয়, তাহলে বিচারিক স্বাতন্ত্র্য লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল, যা সংবিধানবিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
১১৬ অনুচ্ছেদ: নির্বাহী ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের বাধা
সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে জেলা জজ এবং অধঃস্তন বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও শৃঙ্খলামূলক বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কর্তৃত্বের কথা বলা হয়েছে—যিনি এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেন প্রধানমন্ত্রী ও আইন মন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। এর ফলে বিচার বিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়, যা বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা বাস্তবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। উপজেলা পর্যায়ের আদালত বাস্তবায়নের মাধ্যমে যদি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে বিচারকদের প্রশাসনিক বা প্রক্রিয়াগত সংমিশ্রণ ঘটে, তবে এই অনুচ্ছেদের সীমাবদ্ধতাগুলো আরও স্পষ্টভাবে সামনে আসবে।
আইনগত ও সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্পষ্ট যে, উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তর একটি গভীর পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যাতে কোনোভাবেই নির্বাহী প্রভাবের কাছে অবনত না হয়, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। প্রয়োজনে সংবিধান অনুযায়ী সংশোধন, বাস্তবায়ন কাঠামোর পূর্ণ স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষ তদারকি নিশ্চিত না করা হলে, এই প্রস্তাব ভবিষ্যতে বিচার ব্যবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

সুবিধার বদলে বিপদ বেশি: বাস্তবতা ও আশঙ্কা
উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তরের প্রস্তাবের পেছনে ন্যায়বিচারে সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্য থাকলেও বাস্তবতা ও সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় এর বিপদগুলো অগ্রাধিকার পেতে পারে। বর্তমানে বিদ্যমান অবকাঠামোগত দুর্বলতা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং বিচার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা বিষয়গুলো গভীরভাবে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
উপজেলা আদালতের জন্য অবকাঠামো, নিরাপত্তা ও লোকবল ঘাটতি
উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কোর্টরুম, অফিস, তথ্য-প্রযুক্তি সুবিধা এবং নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা এখনও অপর্যাপ্ত। তদুপরি, দক্ষ বিচারক, নাজির, কর্মচারী ও আইনজীবীর সংখ্যা সীমিত, যা দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। অবকাঠামোগত এই ঘাটতি ও মানবসম্পদের অভাব স্থানীয় আদালতের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করবে।
দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের আশঙ্কা
স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসনিক ও বিচারিক কর্তৃপক্ষের মধ্যে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বেশি থাকে। উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থাপিত হলে ক্ষমতার অপব্যবহার, মামলা চলাকালীন অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব ও পক্ষপাতের আশঙ্কা বাড়তে পারে, যা বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
বিচারের মান নিয়ন্ত্রণে কঠিন চ্যালেঞ্জ
উপজেলা পর্যায়ে বিচারের মান রক্ষা এবং সমানভাবে গুণগত বিচার নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মানসম্মত প্রশিক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ না থাকলে বিচারিক ভুল, ধীরগতি এবং অনিয়ম প্রবণতা বেড়ে যাবে, যা বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা হ্রাস করবে।
জনগণের হয়রানি বাড়ার আশঙ্কা
বিচার প্রক্রিয়া যদি স্বচ্ছ না হয় এবং প্রশাসনিক জটিলতা ও দূর্ব্যবহার বেড়ে যায়, তাহলে সাধারণ জনগণের হয়রানি ও মানসিক কষ্ট বাড়বে। তাদের জন্য সময় ও অর্থের অপচয়, বারবার আদালতে যেতে বাধ্য হওয়া এবং অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক চাপ সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়বে।
উপজেলা আদালত স্থানান্তর প্রস্তাবিত সুবিধাগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখিত সমস্যাগুলো অগ্রাহ্য করা হলে তা বিচার ব্যবস্থার জন্য বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই স্থানীয় পর্যায়ে বিচার ব্যবস্থার সংস্কার ও সম্প্রসারণের আগে অবকাঠামো, নিরাপত্তা, লোকবল ও স্বচ্ছতার বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য।

অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য?
উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তরের প্রস্তাব বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বহন করছে কি না, তা নিয়ে নানা আলোচনা ও সন্দেহ জন্মেছে। যেখানে প্রকৃত বিচারিক স্বার্থে পরিবর্তন আনা উচিত, সেখানে কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক প্রভাব ও সুবিধা লাভের লক্ষ্যও প্রবল হতে পারে।
কেন্দ্রীয় বিচারব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ না কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বিকাশ?
বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ মানে সাধারণত ক্ষমতা ও সেবার স্থানীয় পর্যায়ে হস্তান্তর। তবে বর্তমান প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ের আদালতগুলোতে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের—বিশেষ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের—দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হলে এটি স্বাধীন বিচার বিভাগের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা সম্প্রসারণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হতে পারে।
নির্বাচনী এলাকায় প্রভাব বিস্তার ও রাজনৈতিক সুবিধা লাভের চেষ্টা?
উপজেলা আদালত স্থাপনের মাধ্যমে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হতে পারে। নির্বাচনী এলাকায় বিচার ব্যবস্থার ওপর প্রভাব বিস্তার করে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের প্রবণতা দেখা দিতে পারে, যা নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ বিচার কার্যক্রমকে বিঘ্নিত করবে। এমন পরিস্থিতি বিচারের উপর মানুষের আস্থা ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
উপজেলা আদালত স্থানান্তরের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও স্বার্থ আছে কি না তা স্পষ্ট নয়, তবে সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিরোধে যথাযথ তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি। বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিচ্ছিন্ন একটি পরিকল্পিত সংস্কার প্রক্রিয়া প্রয়োজন।

জেলা-অঞ্চলভিত্তিক আদালত ব্যবস্থাই কি যথেষ্ট নয়?
বাংলাদেশে জেলা ও অঞ্চলভিত্তিক আদালত ব্যবস্থা দীর্ঘদিন যাবৎ দেশের বিচার ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে। এই কাঠামোর অধীনে বিচারকেন্দ্রগুলি মামলার বিচার, নিষ্পত্তি ও আইনি সেবা প্রদান করে থাকে, যা দেশের আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি করে এই জেলা-অঞ্চল আদালতগুলোর কার্যকারিতা ও গতি উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, ই-জুডিসিয়াল সেবা, ভার্চুয়াল আদালত এবং দ্রুত মামলার তদারকি ব্যবস্থা কার্যকর করা হলে মামলা নিষ্পত্তির সময় কমানো যায় এবং বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।
অতএব, নতুন উপজেলা পর্যায়ের আদালত স্থাপনের পরিবর্তে বিদ্যমান জেলা-অঞ্চলভিত্তিক আদালত ব্যবস্থার শক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। অধিক আদালত স্থাপন অনেক সময় প্রশাসনিক বিভ্রান্তি, লোকবল ও অর্থনৈতিক সম্পদের অপচয় ঘটাতে পারে, যা বিচার ব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে।
সুতরাং, বিচার ব্যবস্থার গুণগতমান ও দ্রুততা নিশ্চিত করতে জেলা-অঞ্চল আদালত কাঠামোর যথাযথ উন্নয়ন, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার ও মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধিই অধিক ফলপ্রসূ ও টেকসই উপায়।

বিকল্প প্রস্তাব ও সুপারিশ
উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থানান্তরের পরিবর্তে বিচার ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য কিছু বিকল্প ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা বজায় রেখে ন্যায়বিচারে দ্রুত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করবে।
জেলা পর্যায়ে আদালতের সক্ষমতা বৃদ্ধি
জেলা পর্যায়ে আদালতের অবকাঠামো, মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির গতি ও মান উন্নত করা সম্ভব। অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ, আধুনিক কোর্টরুম নির্মাণ ও প্রশাসনিক সহায়তা বাড়িয়ে জেলা আদালতগুলোর কাজের চাপ কমানো যেতে পারে, যা দ্রুত বিচার নিশ্চিত করবে।
ই-জুডিসিয়াল সেবা, ভার্চুয়াল আদালত ব্যবস্থার সম্প্রসারণ
ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে ই-জুডিসিয়াল সেবা এবং ভার্চুয়াল আদালত ব্যবস্থা চালু ও সম্প্রসারণ করার মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া আরও সহজ, সাশ্রয়ী ও দ্রুততর হবে। এতে দূরবর্তী এলাকার মানুষও কম খরচে বিচার সেবা গ্রহণ করতে পারবে এবং মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমে যাবে।
বিচারকদের প্রশিক্ষণ ও বিচারে গতি আনয়নের বিকল্প পথ
বিচারকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান, আধুনিক মামলা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গ্রহণ এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় গতি আনয়নের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ সহ অন্যান্য উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। দক্ষ ও পেশাদার বিচারকের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থার মানোন্নয়ন সম্ভব।
মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ADR ও বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা কাঠামো জোরদার করা
বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR) ব্যবস্থা এবং বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার কার্যক্রম শক্তিশালী করে মামলার চাপ কমানো ও দ্রুত সমাধান নিশ্চিত করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিগুলো বিচার বিভাগে চাপ কমিয়ে জনগণের জন্য সহজ ও কার্যকর বিকল্প সমাধান প্রদান করে।

পরিশেষে বলতে পারি যে,আইন ও বিচারব্যবস্থায় যে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। অপ্রস্তুত ও অপরিকল্পিত সংস্কার বিচার বিভাগের মৌলিক স্বাধীনতা ও কার্যকারিতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে, যা দেশের আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের মূল ভিত্তি ক্ষুণ্ণ করে।
বর্তমানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, কার্যকারিতা এবং সাধারণ জনগণের আস্থা নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতা বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাকে সংকুচিত করছে। তাই বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করাই অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
উপজেলা আদালত স্থাপনের পরিবর্তে বিদ্যমান আদালতগুলোর মানোন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থাকে আরও সুশৃঙ্খল ও জনগণবান্ধব করে তোলা জরুরি। শুধুমাত্র সংখ্যাবৃদ্ধি নয়, বিচার ব্যবস্থার গুণগতমান ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করাই দেশের ন্যায়বিচারের সত্যিকারের সুরক্ষা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category