• মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:২৫ অপরাহ্ন
  • |
  • |

র‌্যাব কর্মকর্তার গুম-হত্যা এবং মসজিদে অর্থ দানের ঘটনা: কমিশনের প্রতিবেদনে ভয়াবহ চিত্র

আল মুস্তাসিম নবী নিকু / ২৯ Time View
Update : বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫
কর্মকর্তার গুম-হত্যা এবং মসজিদে অর্থ দানের ঘটনা: কমিশনের প্রতিবেদনে ভয়াবহ চিত্র

গুম সংক্রান্ত বিশেষ কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরে বিরাজমান নৃশংসতা, দণ্ডমুক্তির সংস্কৃতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক নৈতিক অধঃপতনের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে, কীভাবে সরকারি বাহিনীর অভ্যন্তরে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধগুলো ‘প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন’ আর ‘অপারেশনাল নীতির’ অংশে পরিণত হয়েছিল।

গুমের শিকার প্রায় দুই হাজার, অভিযোগের পাহাড়

কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৮০০টি গুমের অভিযোগ জমা পড়েছে। অধিকাংশ অভিযোগই এসেছে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে সংঘটিত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায়। কমিশনের পর্যবেক্ষণ বলছে, এগুলো নিছক ব্যক্তিগত অসদাচরণ ছিল না বরং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে প্রচলিত ‘পদ্ধতিগত সমস্যা’ ও প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থাপনার প্রতিফলন।

হত্যা করে টাকা দান: ধর্মীয় আচ্ছাদনে অপরাধ ঢাকার চেষ্টা

কমিশনের প্রতিবেদনের সবচেয়ে আলোচিত অংশ হলো এক র‌্যাব কর্মকর্তার নিজের হাতে দু’জন মানুষকে হত্যা করার পর সেই হত্যাকাণ্ডের ‘অপারেশনের’ টাকাগুলো গ্রামের মসজিদে দান করার স্বীকারোক্তি।
এমন স্বীকারোক্তি যখন তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সামনে দেন, তখনও তার বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত হয়নি, নিহতদের পরিচয় জানার চেষ্টা হয়নি কিংবা বিচারিক কোনো প্রক্রিয়া শুরু করা হয়নি।
বরং এই ঘটনা উপস্থাপন করা হয়েছে “ডিব্রিফিং প্রক্রিয়া ঠিকঠাক চলছে”-এর উদাহরণ হিসেবে!

নৈতিক দ্বিধা, কিন্তু বিচারহীনতা

আরেক ঘটনায় দেখা যায়, এক সিনিয়র অফিসার গুমের সাথে জড়িত এক কর্মকর্তার ধর্মীয় অভ্যাস বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বলেন,

“আপনি যে নামাজ পড়েন, সেটা আল্লাহর হক। কিন্তু আপনি যে অপরাধ করেছেন, তা মানুষের হক। আর মানুষের হক নষ্ট করার গুনাহ আল্লাহও মাফ করেন না।”

 

তবে, এত সব জানার পরও উক্ত সিনিয়র কর্মকর্তা তার অধীনস্থ ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো বিচার বা ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।

ভয়, প্রতিশোধ আর ‘না’ বলার সাহসের অভাব

কমিশনের প্রতিবেদনে ভয়াবহ মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতির বর্ণনাও রয়েছে।
তরুণ কর্মকর্তারা নিজেদের ‘অক্ষম ও অসহায়’ বোধ করতেন।
এক সেনা সদস্য জানান,

“আটক ব্যক্তি পালিয়ে গেলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হয়তো তাকে হত্যা করতেন।”

আরেকজন জুনিয়র অফিসার বলেন,

“শুরুতে না বলার সাহস ছিল না, এখন তো আর পিছিয়ে যাওয়ার পথ নেই।”

বেনজীর আহমেদের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে

প্রতিবেদন অনুযায়ী, একাধিক অভিযুক্ত কর্মকর্তা সম্পর্কে তৎকালীন র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সুপারিশপত্রে ‘অত্যন্ত দক্ষ’, ‘সৎ’, ‘নেতৃত্বগুণসম্পন্ন’ বলে প্রশংসা করেছেন।
পরবর্তীতে তিনি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হন।
কমিশন বলেছে, এইসব প্রশংসার ভাষা দেখেই বোঝা যায়,

“প্রতিষ্ঠানীয়ভাবে এই অপরাধগুলো কেমনভাবে ধামাচাপা দেওয়া হতো।”

পুলিশ-সেনাবাহিনী উভয় জায়গায় একই চিত্র

এই নির্যাতন শুধু সেনাবাহিনী বা র‌্যাবে সীমাবদ্ধ ছিল না।
পুলিশের উপ-পরিদর্শকরাও জানিয়েছেন,

“উর্ধ্বতনদের তৈরি করা মিথ্যা কাগজপত্রে জোর করে সই করানো হতো, যাতে তারা চাইলেও অপরাধ থেকে মুক্ত থাকতে পারতেন না।”

 

কমিশনের পর্যবেক্ষণ: ভয়ভীতি, নৈতিক অবক্ষয় এবং দায়িত্বহীনতা

এইসব ঘটনার পর কমিশন বলছে,

“এটি শুধু ভয় আর নির্যাতনের সংস্কৃতি নয়, বরং ঊর্ধ্বতনদের দায়িত্বহীনতা, নৈতিক সহায়তার অভাব এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়ার এক ভয়াবহ উদাহরণ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category