বাজারের অংশীদাররা এ জন্য স্থানীয়ভাবে অপর্যাপ্ত উৎপাদন এবং বেসরকারি আমদানিতে ভাটা এবং প্রতিটি অঞ্চলে চাহিদার অনুপাতে সারের বরাদ্দ ও সরবরাহ ত্রুটিকে দায়ী করেছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে সার সংকটের অভিযোগ আমলে নিতে চাইছেন না। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, আসন্ন ফসল মৌসুমে সারের সংকটের কোনো সম্ভাবনা নেই। সারের বাজারের বর্তমান ঘাটতি কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হচ্ছে।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর শেরপুর-জামালপুর অঞ্চলের বিভিন্ন পর্যায়ের কৃষক এবং সার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরেজমিন আলাপকালে তারা জানিয়েছেন, প্রথাগত ফসলের আবাদ বৃদ্ধির পাশাপাশি বছরব্যাপী কলা এবং শাকসবজির মতো নতুন ফসলের চাষ সারের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক রাসায়নিক সারের সরকারি বরাদ্দ ও সরবরাহ বাড়েনি। ফলে একটি মহল এ ঘাটতির সুযোগ নিচ্ছে। খুচরা বাজারে বেশি দামে সার বিক্রি করছে।
শেরপুর শ্রীবর্দীর ভারেরা বাজারের সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী মো. জাকির হোসেন (৪০) জানান, এখন কৃষকের কোনো জমিই পতিত থাকে না। বছরজুড়ে জমিতে ফসল থাকে। একটা শেষ না হতেই আরেকটা পণ্য চাষ করেন কৃষক। এ জন্য জমিতে সারের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী সার সরবরাহ পাওয়া যায় না। ইউরিয়া, টিএসপি এমওপির সরবরাহ চাহিদার কাছাকাছি হলেও বড়। সংকট ডিএপি সারের।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) নিবন্ধিত এ ডিলার জানান, ‘গোসাইপুর ইউনিয়নের ১৯ হাজার কৃষকের বিপরীতে বরাদ্দ পেয়েছি ১২.২০ টান। কিন্তু ন্যূনতম চাহিদা ৩০ টন। এ কারণে কৃষক পাঁচ বস্তা চাইলে দিতে পারি এক-দেড় বস্তা। তাও যতক্ষণ মজুদ থাকে ততোক্ষণ।’
শ্রীবর্দী পশ্চিম বাজারে ২০০৮ সাল থেকে সরকারের তালিকাভুক্ত ডিলার মো. সামিউল হক (৪২) জানান, ‘রবিশস্যের মৌসুম শুরু না হতেই এবার সার সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ডিএপি সার। বিসিআইসি ও বিএফডিসি আমাদের (ডিলারদের) যে বরাদ্দ দেয় তা কৃষক চাহিদার তুলনায় অনেক কম। প্রয়োজন ১০০ টন, কিন্তু পাচ্ছি ২০ টন। ডিলার দর প্রতি বস্তা (৫০ কোজি) ১ হাজার ৫০ টাকা হলেও, এ দামে কৃষক পাচ্ছেন যতসামান্য। চাহিদার বড় অংশই খুচরা বাজার থেকে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে।’
পার্শ্ববর্তী জেলা জামালপুর সদরের হাজীপুর বাজারের তিন দশকের সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী (ডিলার) জীবন কৃষ্ণ রায় (৬২) জানান, বিএডিসি ও বিসিআইসির বরাদ্দে যে পরিমাণ সার পাই তা স্থানীয় চাহিদার এক দিনের সমান। বাকি ২৯ দিনের চাহিদা অন্য জেলার ডিলারদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনে এনে মিটাই।
২৫ সেপ্টেম্বর এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, ‘চট্টগ্রাম থেকে ১ হাজার ৪৫০ টাকা বস্তা ইউরিয়া এবং ১ হাজার ৫৬০ টাকা বস্তা দরে ডিএপি সংগ্রহ করেছি। খুচরা বিক্রেতাদের কাছে প্রতি বস্তায় ২০-২৫ টাকা লাভে সরবরাহ করছি। এরপর তারা যে যার মতো লাভে বিক্রি করবে। এরপরও কৃষকরা টাকা নিয়ে ঘুরছেন, আশানুরূপ সার পাচ্ছে না।
শেরপুরের ভারের বাজার এলাকায় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে স্থানীয় কৃষক মো. সবুজ মিয়া (২৮) ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এক একর জমিতে আবাদ করতে যেটুকু সার লাগে তার পাঁচ ভাগের এক ভাগও পাচ্ছি না সরকারি দামে। বেশি দামে কিনতেও ঘুরতে হচ্ছে কয়েকবার। ১ হাজার ৫০ টাকা দরের সার কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৬৫০ টাকায়। প্রতি বস্তায় ৫০০ টাকা বেশি। নভেম্বর-ডিসেম্বরে সারের চাহিদা আরও বাড়বে। তখন যে কী অবস্থা হবে বড় চিন্তায় আছি- ‘তবে আমরা এখন জমিতে কাজীর জৈব সার দিচ্ছি। যত চাচ্ছি ততো পাচ্ছি। দামেও ভালো।’ উল্লেখ করেন কৃষক সবুজ মিয়া।
একই থানার দিয়ার চরের কৃষক মজিবর রহমান (৬০) জানান, ‘সরবরাহ আর বেচাকেনায় কঠিন তদারকির কারণে দীর্ঘদিন সারের বড় কোনো সংকট ছিল না। আগে গোডাউন-দোকান সারে ভরা থাকত। এখন সব ফাঁকা। তাই গত বেশ কিছু দিন ধরে প্রয়োজনমতো সার পাচ্ছি না। পাঁচ বস্তা চাইলে ডিলার দেয় এক বস্তা। বাদ বাকি বেশি দামেই কিনছি। প্রতি বস্তা ইউরিয়াতে ২শ/আড়াইশ টাকা আর ডিএপিতে ৪শ থেকে ৫শ টাকা বেশিতে কিনছি। দাম যাই হোক জমির খোরাক জমিকে দিতেই হচ্ছে।’ বলেন ৪ একর জমির খামারি মজিবর।
পার্শ্ববর্তী জেলা জামালপুর সদরের তিতপল্লা ইউনিয়নের পাবই’র কৃষক শামসুল হক (৭০) জানান ‘আগের মতো সার পাচ্ছি না। এক সার চাইলে ডিলার অন্য সার দেয়, তাদের কাছেও থাকে না। অনেক ডিলারের ঘর খোলা কিন্তু সার নাই। চালান আসলেও ৫০ কেজি চাইলে দেয় ১০ কেজি খুচরা দোকান থেকে প্রতি বস্তা ডিএপি ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা আর যমুনার ইউরিয়া দেড় হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। অনেক সময় বেশি টাকা দিয়েও সার পাচ্ছি না। বিকল্প হিসেবে এখন ২ একর জমিতে কাজী কোম্পানির জৈব সার ব্যবহার করছি। ফলনও ভালো হচ্ছে।
সার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ওয়ালিইর রহমান বলেন, ‘বেসরকারি খাতের সার আমদানিকারকের পাওনা টাকা সরকারের কাছে আটকে রয়েছে। যে কারণে অনেকে সার আমদানি করতে পারছে না। সরকারি সংস্থা দুটিও ডিলারদের চাহিদা অনুযায়ী সার বরাদ্দ দিতে পারছে না। যে বরাদ্দ যাচ্ছে তারও একটি অংশ রাজনৈতিক কারণে গোপন গুদামে মজুদ করে সারের সংকট সৃষ্টি করছে। অতীতের সরকারের সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় যারা ডিলারশিপের ব্যবসা করেছেন তাদের অনেকে নানান কারণে পালিয়ে থেকে অন্য লোক দিয়ে সার উত্তোলন করলেও বিক্রি করছে না। আবার এক শ্রেণির ডিলার লাইসেন্স ভাড়া দিয়ে বিদেশে অবস্থান করছে। এরাই মূলত সারের কৃত্রিম সংকটের সঙ্গে জড়িত।’
ব্যবসায়ীদের বকেয়া পরিশোধ করলে, সার আমদানি আরও বাড়লে এবং জেলায় জেলায় মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করলে শিগগিরই সার সংকট কেটে যাবে বলে আশা প্রকাশকরেন সার ব্যবসায়ীদের এই শীর্ষ নেতা। তবে সার সংকটের মাঠ পর্যায়ের তথ্য মানতে চাইছেন না কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া। তাঁর মতে, ‘কিছু কৃত্রিম সমস্যা তৈরি করে সার ঘাটতির ভীতি সৃষ্টি করা হচ্ছে। কিছু ডিলার এর সুযোগ নিয়ে বাড়তি দামে সার বিক্রি করছে বলে শোনা যাচ্ছে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। প্রয়োজনে আইনের আওতায়ও আনা হবে।