তবে একই ধরনের প্রশ্ন এক হাজার বছরেরও বেশি আগে মধ্য আমেরিকার প্রাচীন মায়া সভ্যতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ‘ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, সান্তা বারবারা’র প্রত্নতত্ত্ববিদ ডগলাস কেনেট ও তার দলের এক নতুন গবেষণা বলছে, প্রাচীন মায়া শহরগুলোর উত্থান ও পতন ঘটেছিল পরিবেশ, অর্থনীতি ও মানুষের আচরণ বা সিদ্ধান্তের সমন্বিত প্রভাবের কারণে।
গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস’-এ। গবেষণায় জনসংখ্যা ও পরিবেশের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা খতিয়ে দেখেছেন, কীভাবে ২৫০ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মায়া শহরগুলো ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল ও তারপর তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
মায়ারা কৃষিকাজ করতেন। ফলে জমির ওপরই সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন তারা। গ্রামাঞ্চলে থাকা তাদের জন্য যৌক্তিক বিষয় ছিল। কারণ এতে তারা সহজে জমি ও ফসল দেখাশোনা করতে পারতেন।
তবে ভিড়, জায়গার অভাব, আর রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকাার পরও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক মায়ারা শহরে জড়ো হতে শুরু করেছিলেন। কেন তারা গ্রাম ছেড়ে শহুরে জীবন বেছে নিয়েছিলেন?
কেনেট বলেছেন, জলবায়ু বা প্রাকৃতিক সমস্যা, বিশেষ করে খরার সময় শহরে বসবাস করা মায়াদের জন্য নতুন সুবিধা এনে দিয়েছিল। কারণ তখন শহরে থাকা মানুষদের জন্য নিরাপত্তা, সহযোগিতা আর খাবারের জোগান পাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল।
উন্নত কৃষি ব্যবস্থা, যেমন– সেচব্যবস্থার মতো প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বিভিন্ন শহরকে আরও বেশি মানুষের জন্য খাবার সরবরাহ ও সহায়তা করতে পেরেছিল। তবে সেখানে ধনী-গরিবের পার্থক্য থাকলেও এসব শহর শক্তিশালী ও অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম হয়ে ওঠে।
তবে এসব শহরের সাফল্যই শেষ পর্যন্ত এদের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের আশপাশে পরিবেশের ক্ষতি জীবনের মানকে কঠিন করে তোলে। বনের গাছ কেটে ফেলা হয়, মাটির উর্বরতা কমে যায় ও পানির উৎস নির্ভরঅযোগ্য হয়ে পড়ে। তখন মায়া মানুষরা আবার গ্রামে ফিরে যেতে শুরু করে।
ওই সময় অনেক মানুষ হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন, শহরের ভিড়, সমস্যা ও অস্থিরতার থেকে মুক্ত হয়ে গ্রামে ফিরে গেলেই তাদের জীবন সহজ ও শান্তিপূর্ণ হবে।
কেনেট ও তার দল দলটি বলেছে, বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, অনেক মায়া শহর খরার সময় নয়, বরং যখন আবহাওয়া উন্নতির দিকে যাচ্ছিল তখনই পরিত্যক্ত হয়েছিল। ফলে কেবল শুষ্কতা বা খরা এসব শহরের পতনের কারণ ছিল এই দীর্ঘদিনের ধারণাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এ গবেষণা। এ গবেষণায় উঠে এসেছে, গ্রামাঞ্চল আবার বাসযোগ্য ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠল তখনই এসব শহর মানুষের আকর্ষণ হারিয়ে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল।
জলবায়ু, সংঘাত, জনসংখ্যা ও কৃষির বিভিন্ন তথ্যকে উন্নত কম্পিউটার মডেলিংয়ের সঙ্গে যোগ করে গবেষকরা দেখিয়েছেন, কীভাবে একাধিক কারণ, বিশেষ করে সামাজিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক একসঙ্গে মিলে মায়াদের জীবনযাত্রা ও বিভিন্ন শহরের উন্নয়ন ও পতন ঘটিয়েছিল।
গবেষণাটি কেবল প্রাচীন ইতিহাসের ওপরই নজর দেয়নি, বরং আধুনিক বিভিন্ন শহরের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছে। মায়াদের ইতিহাস থেকে আমরা বুঝতে পারি, কীভাবে শহরের বড় হওয়া, প্রাকৃতিক সম্পদের সীমা ও পরিবেশের পরিবর্তন একসঙ্গে মানুষের জীবনকে গঠন করে, যা বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক।
মায়াদের গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শহরে থাকা সুবিধাজনক হলেও এর সঙ্গে নানা সমস্যা এবং ঝুঁকিও থাকে এবং এই দুইয়ের মধ্যে সমতা বজায় রাখা খুবই কঠিন ও জটিল কাজ।