• সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:৩৮ পূর্বাহ্ন
  • |
  • |
Headline :
ছাত্রদলকে ভোট দিতে ঢাবি ছাত্রীকে ফোন জেলা বিএনপি সভাপতির, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন আজকে দেশে থাকলে আমাকে ভিক্ষা করে খেতে হতো : আহমেদ শরীফ কোটালীপাড়ায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার শ্যামনগর উপকূল মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য মিনি গার্মেন্টস তৈরি মান্দায় শিক্ষা অফিসারের নৌকা ভ্রমণ: সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষায় জনমনে ক্ষোভ মুকসুদপুরে আলোচিত নৈশপ্রহরী গৌতম হত্যা মামলায় একজনকে আটক করেছে পুলিশ চাটমোহরে একরাতের আগুনে নি:স্ব ৫ পরিবার অক্টোবরেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালু, থাকবে ৫ খাবার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জাপানের প্রধানমন্ত্রীর পাবনায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আসামী ছাত্রলীগ সভাপতি শান্ত সহ গ্রেফতার ৩

উত্তরার আকাশে আগুন: ব্যর্থ ব্যবস্থাপনার আগুনে পুড়ল শিশুদের জীবন

আল মুস্তাসিম নবী নিকু / ১০৩ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২২ জুলাই, ২০২৫
আল মুস্তাসিম নবী নিকু

প্রতিবেদন:

আমরা কি জাতি হিসেবে অসভ্য হয়ে যাচ্ছি?
এই প্রশ্নটি এখন অনেকের হৃদয়ে জ্বলছে। কারণ, রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্বহীনতা ও কিছু মানুষের অমানবিক সুবিধাবাদিতা আমাদের বিবেককে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে। উত্তরার দিয়াবাড়িতে সাম্প্রতিক বিমান দুর্ঘটনা শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়—এটি জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার নগ্ন প্রকাশ।

ঘটনার সূচনা একটি ত্রুটিযুক্ত প্রশিক্ষণ বিমানে পাইলটকে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে। নিহত প্রশিক্ষণার্থী পাইলট ছিলেন পাবনা ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী। তিনি ছিলেন তার প্রশিক্ষণের একেবারে শেষ ধাপে—সলো ফ্লাইট। অথচ, তাকে উঠতে হয়েছে এমন একটি বিমানে যার পূর্বেই কারিগরি ত্রুটির অভিযোগ ছিল।
রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ কীভাবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়? কোন অজুহাতে? কার স্বার্থে?

দায়িত্বহীন সেই সিদ্ধান্তের ভয়াবহ ফলাফল: বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পতিত হয় উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাইমারি সেকশনের ভবনের উপর। কারও কারও অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায় স্কুলটি বিমান চলাচলের এলাকার কাছাকাছি অবস্থিত—অর্থাৎ শুরু থেকেই এটি ছিল একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—এমন স্পর্শকাতর এলাকায় স্কুল করার অনুমোদন কীভাবে দেওয়া হয়েছিল?
বিমান চলাচলের রুটে শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান—এ কেমন পরিকল্পনা?

এই দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে ও হাসপাতালে অসংখ্য শিশুশিক্ষার্থী নিহত হয়। আগুনে পুড়ে গলে যাওয়া তাদের শরীরের অবস্থা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, অনেক শিশু এমনভাবে দগ্ধ হয়েছে যে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই নির্মম ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন এক মহিলা শিক্ষক মেহরীন চৌধুরি (প্রাইমারি সেকশন), যিনি আহত শিশুদের বাঁচাতে বারবার আগুনের ভেতরে ঢুকে পড়েছিলেন। তাঁর পক্ষে নিজেকে বাঁচানো সম্ভব ছিল, কিন্তু তিনি সেই সুযোগ গ্রহণ করেননি। এক মহান আত্মত্যাগের এই উদাহরণ হয়তো ভবিষ্যতের উল্লেখ যোগ্য থাকবে, কিন্তু আমরা কি এমন আত্মত্যাগকে সত্যিকারের মূল্য দিতে পারবো?

দ্বিতীয় বিপর্যয়: হাসপাতালের অব্যবস্থা

দুর্ঘটনার পর আহতদের নেওয়া হয় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থার ভেতরেও দেখা যায় ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দলে দলে আগমন, হাসপাতালে ভিড়, সেলফি ও শো-অফের প্রতিযোগিতা—সব মিলিয়ে চিকিৎসার স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত হয়।
বিশেষ করে বার্ন ইউনিটগুলোতে অতিরিক্ত ভিড় ও কোলাহলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চিকিৎসকেরা জানান, অতিরিক্ত জনসমাগম সংবেদনশীল ওয়ার্ডে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

অবশ্য ইতিবাচক দিকও ছিল—বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভলান্টিয়াররা রক্ত সংগ্রহ, ওষুধ জোগাড়, যানজট এড়িয়ে আহতদের দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়াসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করেছেন। তাদের আন্তরিকতার প্রশংসা না করে পারা যায় না।

কিন্তু সমস্যা তৈরি হয়েছে যখন উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল উপদেষ্টাগণ ও রাজনৈতিক নেতারা প্রটোকলসহ গাড়িবহর নিয়ে হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। এতে যানজট বৃদ্ধি পায় এবং জরুরি পরিবহনের গতি বাধাগ্রস্ত হয়।

তৃতীয় অসভ্যতা: বাণিজ্যিক সুযোগ সন্ধান

অভিযোগ পাওয়া যায় ঘটনার ভয়াবহতা শুরুর সময় অনেক পরিবহন চালক আহতদের পরিবহন করতে অনাগ্রহ দেখিয়েছেন, এমনকি সুযোগ বুঝে কিছু পরিবহন তাদের ভাড়া কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এই অমানবিক লোভ আমাদের সমাজের আরেক কুৎসিত রূপ উন্মোচন করে।

কিন্তু আশার কথা, এই দুঃসময়ে সাধারণ মানুষ, পথচারী, ছাত্র, এমনকি রিকশাচালকেরাও নিজের সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। তারা আহতদের কাঁধে করে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন, পানি এনে দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন।
এরা প্রমাণ করেছে, জাতি এখনও পুরোপুরি অসভ্য হয়নি—মানবিকতা এখনও বেঁচে আছে সাধারণ মানুষের মাঝে।

কঠিন কিছু প্রশ্ন

এই ঘটনার পর কিছু জরুরি প্রশ্ন জাতি হিসেবে আমাদের করতে হবে:

** ত্রুটিযুক্ত বিমানে প্রশিক্ষণ কেন?
** বিমান চলাচলের রুটে স্কুল ভবন নির্মাণের অনুমোদনের সিদ্ধান্ত কি ভাবে হল?
** হাসপাতালের অপ্রয়োজনীয় ভিড় রোধে সরকারি তৎপরতা কোথায়?
** প্রটোকল ও নিরাপত্তার নামে অ্যাম্বুলেন্স গতি থামিয়ে দেওয়ার দায় কে নেবে?
** দুর্ঘটনার সময় পরিবহন সংকট কেন ছিল?
** এই ট্র্যাজেডিতে প্রকৃত দায় কার?

পরিশেষে, উত্তরার আকাশে পতিত হওয়া বিমানটি শুধু একটি যান্ত্রিক ব্যর্থতা নয়, এটি এক নৈতিক ব্যর্থতার প্রতীক। এই ঘটনায় হারিয়ে যাওয়া শিশুরা আমাদের বিবেককে জাগিয়ে দিয়েছে—আমরা কতটা অমানবিক হলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে?

জাতি হিসেবে যদি আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না খুঁজি, দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি না করি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংস্কার না করি—তাহলে আগামী দিনে আরেক মাইলস্টোন, আরেক শিক্ষক, আরেক কোমলমতি শিশু এমন নিষ্ঠুর পরিণতির শিকার হবে।

আর তখন আর প্রশ্ন করার অধিকার আমাদের থাকবে না।

লেখক পরিচিতি:
আল মুস্তাসিম নবী নিকু
অ্যাডভোকেট, ঢাকা ও পাবনা জজ কোর্ট


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category